নিজস্ব প্রতিবেদক: ইউক্রেন যুদ্ধের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব, অর্থনৈতিক অস্থিরতা এবং তরুণ প্রজন্মের সন্তান গ্রহণে অনাগ্রহ—সব মিলিয়ে অস্তিত্ব সংকটে বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি রাশিয়া। দেশটিতে আশঙ্কাজনক হারে কমছে জন্মহার। এই সংকট কাটাতে রুশ সরকার একের পর এক নজিরবিহীন ও অদ্ভুত সব পরিকল্পনা হাতে নিচ্ছে। সম্প্রতি সবচেয়ে বেশি আলোচনার জন্ম দিয়েছে রাতে নির্দিষ্ট সময়ে বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন রাখার প্রস্তাব।
রুশ নীতিনির্ধারকদের ধারণা, প্রযুক্তির আসক্তি কমিয়ে মানুষকে ‘অফলাইন’ করতে পারলে দম্পতিরা একে অপরকে বেশি সময় দেবেন, যা পরোক্ষভাবে জন্মহার বাড়াতে ভূমিকা রাখবে। তবে বিচিত্র এই প্রস্তাব ঘিরে শুরু হয়েছে তুমুল বিতর্ক।
প্রযুক্তির আসক্তি বনাম পারিবারিক সম্পর্ক
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ‘লাইভ মিন্ট’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, উন্নত বিশ্বের অনেক দেশের মতোই রাশিয়ায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার নিম্নমুখী। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় রুশ নীতিনির্ধারকরা এক অপ্রচলিত দাওয়াই খুঁজছেন। প্রস্তাব অনুযায়ী, রাতে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বাসাবাড়িতে ইন্টারনেট এবং বিদ্যুৎ সরবরাহ সীমিত করা হতে পারে।
এই অদ্ভুত প্রস্তাবের পক্ষে যুক্তিও দেখিয়েছেন সমর্থকরা। তাদের মতে, বর্তমান সময়ে স্মার্টফোন, সোশ্যাল মিডিয়া এবং ইন্টারনেটের অবাধ ব্যবহার মানুষের ঘুমের প্যাটার্ন এবং পারিবারিক সম্পর্কে বড় ধরনের ফাটল ধরিয়েছে। দম্পতিরা রাতে বিশ্রাম বা একান্ত সময় কাটানোর বদলে স্ক্রিনে ডুবে থাকছেন।
সরকার মনে করছে, যদি কৃত্রিমভাবে এই ‘ডিজিটাল আসক্তি’ কমানো যায়, তবে মানুষ বাধ্য হয়েই পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সময় কাটাবে। এতে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটবে এবং সন্তান নেওয়ার আগ্রহ বাড়তে পারে। একে অনেকে ঠাট্টা করে ‘প্রেমময় অন্ধকার’ তৈরির সরকারি প্রচেষ্টা বলে অভিহিত করছেন।
‘মিনিস্ট্রি অব সেক্স’ এবং বিচিত্র সব প্রণোদনা
শুধু বিদ্যুৎ বা ইন্টারনেট বন্ধ করাই নয়, জনসংখ্যা বাড়াতে আরও কিছু চমকপ্রদ প্রস্তাবনা রাশিয়ার সরকারি মহলে আলোচিত হচ্ছে। এর মধ্যে ‘মিনিস্ট্রি অব সেক্স’ বা যৌন বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠনের ভাবনাটি সবাইকে অবাক করেছে।
গোসলের ভিডিও ধারণ করে ব্ল্যাকমেইল: প্রেমিকের বাড়িতে নারীর অবস্থান
বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুনজনসংখ্যা বৃদ্ধিতে দম্পতিদের উৎসাহিত করতে বিভিন্ন আর্থিক প্যাকেজের কথাও ভাবা হচ্ছে। যেমন:
-
প্রথম সন্তান ভাতা: প্রস্তাব অনুযায়ী, পরিবারে প্রথম সন্তান জন্ম নিলেই বাবা-মাকে ৫,০০০ রুবল পর্যন্ত বিশেষ সহায়তা দেওয়া হতে পারে।
-
বিয়ের প্রথম রাত: নবদম্পতিদের বিয়ের প্রথম রাতে বিশেষ কোনো স্থানে সময় কাটানোর জন্য সরকারিভাবে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার প্রস্তাবও রয়েছে।
-
মাদার হিরোইন পুরস্কার: যারা ১০ বা তার বেশি সন্তানের জন্ম দেবেন, তাদের জন্য সোভিয়েত আমলের ঐতিহ্যবাহী ‘মাদার হিরোইন’ পুরস্কার পুনরায় চালু করা হয়েছে।
এছাড়া মাতৃত্বকালীন ছুটির পাশাপাশি বাবাদের জন্যও বিশেষ সুবিধা বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে পুতিন সরকার। বর্তমানে দেশটিতে সন্তান জন্মদানে এককালীন অর্থ ও পারিবারিক সহায়তা কর্মসূচি চালু রয়েছে।
সমালোচকদের চোখে বাস্তবতা
সরকারের এসব উদ্যোগকে অনেকেই ‘অবাস্তব’ ও ‘হাস্যকর’ বলে উড়িয়ে দিচ্ছেন। সমালোচকদের মতে, জন্মহার কমে যাওয়ার মূল কারণ ইন্টারনেট বা বিদ্যুৎ নয়। বরং এর পেছনে রয়েছে গভীর অর্থনৈতিক সংকট।
রাশিয়ার সাধারণ নাগরিকদের মতে, বর্তমানে জীবনযাত্রার ব্যয় আকাশচুম্বী। আবাসন সংকট, চাকরির অনিশ্চয়তা এবং সন্তানের ভবিষ্যৎ লালন-পালনের খরচ মানুষকে সন্তান নিতে নিরুৎসাহিত করছে। কেবল রাতে বাতি নিভিয়ে দিলেই এই সমস্যার সমাধান হবে না।
তাছড়া, আধুনিক যুগে ইন্টারনেট বন্ধের সিদ্ধান্ত কতটা যৌক্তিক, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ফ্রিল্যান্সার, আইটি কর্মী, চিকিৎসক কিংবা শিক্ষার্থীরা—যাদের কাজের বড় একটা অংশ রাতের বেলার ওপর নির্ভরশীল, তাদের জন্য এই সিদ্ধান্ত বড় ভোগান্তির কারণ হতে পারে। সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, রাষ্ট্রীয় নির্দেশ দিয়ে ব্যক্তিগত আবেগ বা রোমান্স তৈরি করা সম্ভব নয়।
পুতিনের উদ্বেগ ও পরিসংখ্যানের ভয়াবহ চিত্র
জনসংখ্যা সংকট যে রাশিয়ার জন্য কতটা উদ্বেগের, তা বোঝা যায় প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিভিন্ন মন্তব্যে। গত বছরের শেষ দিকে তিনি কর্মক্ষেত্রে লাঞ্চ ব্রেক বা কফি পানের বিরতিতে সন্তান নেওয়ার বিষয়ে মন্তব্য করে বিশ্বজুড়ে শোরগোল ফেলে দিয়েছিলেন।
রাশিয়ার পরিসংখ্যান সংস্থা ‘রোসস্ট্যাট’-এর তথ্য অনুযায়ী, দেশটির জনসংখ্যা পরিস্থিতির চিত্র বেশ ভয়াবহ।
-
২০২৪ সালে রাশিয়ায় মাত্র ১২ (বারো) লাখ ২২ (বাইশ) হাজার শিশুর জন্ম নথিভুক্ত হয়েছে।
-
এই সংখ্যা ১৯৯৯ সালের পর দেশটিতে সর্বনিম্ন।
-
২০১৪ সালের তুলনায় বর্তমানে জন্মহার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কমে গেছে।
একদিকে ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে তরুণ প্রজন্মের একটি বড় অংশ রণক্ষেত্রে, অন্যদিকে দেশের ভেতরে অর্থনৈতিক চাপ—সব মিলিয়ে রাশিয়ার ডেমোগ্রাফিক বা জনমিতিক কাঠামো বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্যই হয়তো বিদ্যুৎ-ইন্টারনেট বন্ধের মতো মরিয়া সিদ্ধান্তের কথা ভাবছে ক্রেমলিন। তবে এই ‘অন্ধকার থেরাপি’ আদতে কতটা কাজে আসবে, নাকি কেবল সমালোচনার জন্ম দেবে—তা সময়ই বলে দেবে।
মূল হাইলাইটস (Quick Summary):
-
সমস্যা: রাশিয়ার জন্মহার ১৯৯৯ সালের পর সর্বনিম্ন পর্যায়ে।
-
প্রস্তাব: রাতে নির্দিষ্ট সময়ে বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট বন্ধ রাখা।
-
উদ্দেশ্য: স্ক্রিন টাইম কমিয়ে দম্পতিদের ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া।
-
অন্যান্য পরিকল্পনা: ‘মিনিস্ট্রি অব সেক্স’ গঠন, প্রথম সন্তানের জন্য ৫০০০ রুবল বোনাস, ‘মাদার হিরোইন’ পুরস্কার চালু।
-
সমালোচনা: অর্থনৈতিক সমস্যা ও আবাসন সংকট সমাধান না করে ইন্টারনেট বন্ধকে অবাস্তব মনে করছেন অনেকে।

