ধর্ম ও জীবন ডেস্ক:
মানুষ ফেরেশতা নয়, তাই ভুল হওয়াটাই মানুষের স্বভাব। শয়তানের ধোঁকায় পড়ে কিংবা নফসের খাহেশে আমরা অনেক সময় এমন সব গুনাহ করে ফেলি, যা মনে পড়লে নিজের বিবেকের কাছেই লজ্জিত হতে হয়।
পাপ করার চেয়েও বড় বিপদ হলো—পাপের পর আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ে যাওয়া। শয়তান আমাদের মনে এই ভয় ঢুকিয়ে দেয় যে, “তোমার পাপের বোঝা এত ভারী যে, আল্লাহ তোমাকে আর ক্ষমা করবেন না।”
কিন্তু আসলেই কি তাই? বান্দার পাপ কি আল্লাহর দয়ার চেয়ে বড় হতে পারে?
এর উত্তর লুকিয়ে আছে সহীহ বুখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত বনী ইসরাইল যুগের একটি লোমহর্ষক অথচ আশাজাগানিয়া ঘটনায়।
১০০ খুনের পরও ক্ষমার আশা
ঘটনাটি অনেক কাল আগের। বনী ইসরাইল গোত্রের এক ব্যক্তি ছিল চরম পাপাচারী। সে একে একে ৯৯ জন মানুষকে হত্যা করেছিল। কিন্তু একসময় তার বিবেক জাগ্রত হলো। অনুশোচনায় তার বুক ফেটে যাচ্ছিল। সে ভাবল, “আমি কি এই ভয়াবহ পাপ থেকে মুক্তির কোনো পথ পাব না?”
অজ্ঞতার কারণে বিপদ ও সেঞ্চুরি পূর্ণ
রাতে কিছুতেই ঘুম আসছে না? মহানবী (সা.) শিখিয়েছেন যে বিশেষ আমল ও দোয়া #ঘুমের_দোয়া
বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুনতওবার আশায় লোকটি এক খ্রিস্টান সন্ন্যাসী বা আবেদের কাছে গেল। ওই সন্ন্যাসী ইবাদত-বন্দেগি করলেও তার ধর্মীয় জ্ঞানের গভীরতা ছিল না। খুনি তাকে জিজ্ঞেস করল, “আমি ৯৯ জন মানুষকে হত্যা করেছি। আমার জন্য কি ক্ষমার কোনো সুযোগ আছে?”
অজ্ঞ সন্ন্যাসী উত্তর দিল, “না! এত বড় পাপ আল্লাহ কখনোই মাফ করবেন না।”
হতাশায় ও রাগে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে লোকটি সেই সন্ন্যাসীকেও হত্যা করে বসল। ফলে তার খুনের সংখ্যা পূর্ণ হলো ১০০-তে।
জ্ঞানী আলেমের সঠিক পরামর্শ
তবুও তার মনের অস্থিরতা কমল না। সে আবার খোঁজ নিতে শুরু করল—শহরের সবচেয়ে বড় জ্ঞানী ব্যক্তি কে আছেন। অবশেষে এক বিজ্ঞ আলেমের সন্ধান পেল। তার কাছে গিয়ে সে আকুতি জানাল, “আমি ১০০টি খুন করেছি। আল্লাহ কি আমাকে মাফ করবেন?”
জ্ঞানী আলেম তাকে অভয় দিয়ে বললেন, “অবশ্যই! আল্লাহর রহমত ও বান্দার তওবার মাঝে কে প্রাচীর হয়ে দাঁড়াতে পারে?”
তবে আলেম তাকে শুধু আশাই দিলেন না, বরং তওবা কবুলের জন্য একটি কার্যকরী উপায় বাতলে দিলেন। তিনি বললেন, “তুমি তোমার নিজ এলাকা ছেড়ে অমুক গ্রামে চলে যাও। সেখানে অনেক নেককার মানুষ বাস করেন। তাদের সঙ্গ গ্রহণ করো, ইবাদত করো এবং আর কখনো পাপের এই জনপদে ফিরে এসো না।”
হিজরতের পথে মৃত্যু ও অলৌকিক ফয়সালা
আলেমের পরামর্শ মেনে লোকটি নেককারদের গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হলো। কিন্তু পথের মাঝখানেই তার মৃত্যু উপস্থিত হলো। মৃত্যুর চরম যন্ত্রণার মুহূর্তেও সে নিজের বুকটাকে নেককারদের গ্রামের দিকে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করল।
তার রুহ কবজ করার পর জান্নাত ও জাহান্নামের ফেরেশতাদের মধ্যে তর্ক শুরু হয়ে গেল।
জাহান্নামের ফেরেশতারা বলল, “এই লোক সারাজীবন শুধু পাপই করেছে, ভালো কোনো কাজ করেনি। তাই সে জাহান্নামী।”
অন্যদিকে রহমতের ফেরেশতারা দাবি করল, “সে খাঁটি অন্তরে তওবা করে আল্লাহর দিকে ফিরে আসছিল।”
তখন আল্লাহ তায়ালা মানুষের বেশে একজন ফেরেশতাকে বিচারক হিসেবে পাঠালেন। সিদ্ধান্ত হলো—দুই গ্রামের দূরত্ব মাপা হবে। মৃতদেহটি যে গ্রামের (পাপের গ্রাম নাকি নেককারদের গ্রাম) বেশি কাছে পাওয়া যাবে, সে অনুযায়ী তার ফয়সালা হবে।
আল্লাহর রহমতের জয়
হাদিসের বর্ণনায় এসেছে, আল্লাহ তখন জমিনকে নির্দেশ দিলেন— “নেককারদের গ্রামকে মৃতদেহের কাছে নিয়ে এসো এবং পাপের গ্রামকে দূরে সরিয়ে দাও।”
পরিমাপ করে দেখা গেল, লোকটি গন্তব্যস্থলের (নেককারদের গ্রামের) দিকে মাত্র এক বিঘত (হাতের মাপ) পরিমাণ বেশি এগিয়ে ছিল। ফলে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিলেন এবং রহমতের ফেরেশতারা তাকে জান্নাতে নিয়ে গেলেন।
(সূত্র: সহীহ বুখারী: ৩৪৭০, সহীহ মুসলিম: ২৭৬৬)
আমাদের জন্য শিক্ষা
এই ঘটনাটি শুধু একটি গল্প নয়, বরং হতাশায় নিমজ্জিত মানুষের জন্য আশার আলো। এখান থেকে আমরা গুরুত্বপূর্ণ কিছু শিক্ষা পাই:
১. আল্লাহর রহমত অসীম: আল্লাহ তায়ালা কুরআনে ঘোষণা করেছেন, “হে আমার বান্দারা, যারা নিজেদের ওপর অবিচার করেছ, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না।” (সূরা যুমার: ৫৩)
২. পরিবেশ পরিবর্তন জরুরি: তওবা কবুলের জন্য শুধু মৌখিক অনুশোচনা যথেষ্ট নয়। যে পরিবেশ বা সঙ্গ আপনাকে পাপের দিকে টানে, তা ত্যাগ করা তওবার একটি অপরিহার্য শর্ত।
৩. জ্ঞানীর মর্যাদা: ইবাদতের চেয়ে সঠিক দ্বীনি জ্ঞান থাকা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। একজন অজ্ঞ ইবাদতকারী মানুষকে ভুল পথে চালিত করতে পারে, কিন্তু একজন প্রকৃত আলেম সঠিক পথের সন্ধান দেন।
৪. শেষ চেষ্টার মূল্যায়ন: হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ বলেন, “বান্দা যখন আমার দিকে এক বিঘত এগিয়ে আসে, আমি তার দিকে এক হাত এগিয়ে যাই।” নিয়ত ও চেষ্টা আল্লাহর কাছে অনেক মূল্যবান।
উপসংহার
প্রিয় পাঠক, ১০০ খুনের মতো জঘন্য অপরাধ যদি ক্ষমা হতে পারে, তবে আপনার-আমার পাপ কেন ক্ষমা হবে না? শয়তানের সবচেয়ে বড় প্ররোচনা হলো— “এখন আর ফিরে আসার সময় নেই।”
অথচ সত্য হলো, যতক্ষণ নিঃশ্বাস আছে, ততক্ষণ তওবার দরজা খোলা। আসুন, অতীত নিয়ে হতাশ না হয়ে আজই মহান রবের কাছে নত হই। এক ফোঁটা অনুতপ্ত চোখের পানিই পারে জাহান্নামের আগুন নিভিয়ে দিতে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে খাঁটি তওবা করার তৌফিক দিন। আমিন।

